কলরবের কলতানে একটু অনুভূতি, বিমুগ্ধতার জ্যোতি ( রোজনামচা )
কলরবের কলতানে
একটু অনুভূতি, বিমুগ্ধতার জ্যোতি
( রোজনামচা )
[রুকন রাশনান লুবান]
কলরব। বাংলা শব্দটার সাথে সকলে পরিচিত। কল মানে মিষ্টি, রব মানে আওয়াজ। কলরব মানে মিষ্টি আওয়াজ। কিছু শব্দ শ্রুতিমধুর হয়। সব ভাষায় এরকম হয়। উর্দুতে একটা শব্দ আছে, কাশমাকাশ। উচ্চারণ করে দেখুন। ভালো লাগবে। আরবিতে এরকম শব্দভাণ্ডার আছে। একটা বলি? মুহাম্মদ। শুনতে বলতে মজাদার। ফার্সিতে আছে, যেমন, গুলে লালা। হিন্দিতে আছে, যেমন, জানকারি। ইংরেজিতে আছে, যেমন, ডিউ। এগুলো সুষমাময়ী শব্দ। কলরব এ গোত্রীয় শব্দ। অর্থতর্থ বাদ দিলেও এসব শব্দ স্রোতাকে টানে।
কলরব একটা প্রতিষ্ঠানের নাম। মাঝেমাঝে শব্দ তার নিজকীয়তা নামকরণে হারিয়ে ফেলে। বসুন্ধরা বললে, এখন কেউ পৃথিবী বুঝে না। একটা বহুজাতিক কোম্পানির কাছে বসুন্ধরা ভাষাবোধের ডুমেইন হারিয়ে ফেলেছে। কলরব, বলতে মিষ্ট নিনাদ। তবে, এখন কলরব একটা প্রতিষ্ঠানে ঝঁকে গেছে। শব্দ ব্র্যান্ডের কাছে বিমিশ্র হয়। কলরব একটি জাতীয় সংগঠনের নাম। এটা আপনি জানেন।
কলরব একটা সাংস্কৃতিক সংগঠন। তাঁরা কী করে? বহু কিছু করে। ইসলামকে মেনে সাংস্কৃতিক কর্মবলয়ের বহুত কাজে তাঁরা মশগুল। আলহামদুলিল্লাহ্।
ইসলামি, গান করে তাঁরা। হামদ, নাআত, জাগরণী গান, বক্তৃতা, আবৃত্তি, গজল সব তারা দশক ধরে করে আসছে। তাঁদেরকে শুকরান।
এটার সূচনা করেছিলেন মরহুম শহিদ আইনুদ্দীন আল আযাদ আলাইহির রহমত। তাঁকে আপনার মনে থাকার কথা। তাঁকে এদেশের মুসলিম মানস ভুলতে পারার সুযোগ তিনি রাখেন নি। মানুষ সৃষ্টিতে জীবন্ত থাকেন। তিনি সাড়া জাগানো গান জীবনব্যাপী গেয়েছেন। তাতেই তিনি অমর আলহামদুলিল্লাহ্। তিনি তাতে ক্ষান্ত থাকেন নি, গান লিখে ও গেয়ে ক্লান্ত হন নি। তিনি গান-গজলের বৃন্দাবন রচনা করেছেন। কলরবের মতো বিটপী, আরো সঘন বীথিকা রেখে গেছেন। আল্লাহ তায়ালা তাঁর কবরকে খুশজোশের জান্নাত করুন। আমিন।
বা
আজ কলরবের একটা ফুর্তি অনুষ্ঠান হচ্ছে। আমি তেমন একটা কোথাও যাই না। ভুল বললাম, লজ্জায় যেতে পারি না। আমার বেশভূষা এতো অসুন্দর যে, শয়তানও লজ্জা পায়। আমি আরো বড় শয়তান।
কলরব নামটা আমার ভালো লাগে। কলতান হলে কেমন হত? ভালো হত না। কলরব কলতানের চেয়ে সুন্দর। কুহুতান হলে, তাও না। আজকের অনুষ্ঠানে আমাকে ব্যাপক চাপাচাপি ও ভালোবাসাসহ দাওয়াত করেছেন অত্যন্ত প্রিয় এক সুজন। তাঁর দাওয়াত উপেক্ষা করা অন্যায়। তদুপরি, কলরবের ভালোবাসা আমার হৃদয়ে কলরোল আছে সবমসময়। কেন? তাঁদের ঐন্দ্রজালিক সব সুরের বীণা আমাকে সুখ ও পুলক উপহার দেয়, এজন্য।
কলরবের আজকের অনুষ্ঠানের একটা নাম আছে। ক্বেরাত-নাশিদ মাহফিল। নামটা আমাকে প্রফুল্ল করল। তিন শব্দের নাম। প্রতিটি শব্দ আরবি। কলরব যে আরব্য সুধার সুরভি ছড়াবে, এটা এই নামকরণ বলে দেয়। তাঁদের সাংস্কৃতিক বোধ ও আরবির প্রতি দরদ আমাকে মোহিত করেছে। জাযাকুমুল্লাহ।
ক্বেরাত মানে বুঝেন ত! কুরআনের বিশুদ্ধ তেলাওয়াত। কুরআন কেউ ভুল পড়লেও আমি মুগ্ধ হই, কষ্ট পেলেও ভালোই লাগে। সেখানে কুরআনের সুললিত তেলাওয়াত হবে! আমার কান লোভাতুর হয়ে সচকিত হল।
নাশিদ। এটা আবার কী? মাওলানারা বুঝবেন। আমার মতো অপাংক্তেয়দের ঝামেলা হবে। এজন্য একটু বলি? নাশিদ আরবি শব্দ। সুন্দর না শব্দটা? আমাদের কারো কারো আম্মাজান ও বউয়ের নামও নাশিদ রাখা হয়।
নাশিদ মানে বিশেষ গান। গজল শব্দও আরবি। আরবিতে কবিতাকে বলে, শেয়ের। পদ্যকে বলে, নাসার। নাশিদের উৎপত্তিগত অর্থ হল, উচ্চস্বরে কিছু বলা। গান তো উচ্চ আওয়াজে গাওয়া হয়। কোরাস করে গান গাওয়াকে আরবরা নাশিদ বলে। এটার বহুবচন আনশুদা ও আনাশিদ।
কলরব চাইলে সংগীত বলতে পারত। কেন বলে নি? আমার অনুমান, সংগীতে বাদ্যের বিষয় আছে। এটা ত নিরেট গান। এজন্য আরবি নাশিদকে চয়ন করা হল। খেয়াল করুন, বাক্যবয়নে তাঁরা কতো চৌকশ! আল্লাহ তাঁদের দূরদর্শিতাকে মকবুল করুন। আমিন!
মাহফিল তো আপনি বুঝেনই। সম্মেলন।
তাহলে কী দাঁড়াল! আজকে কলরব কুরআন তেলাওয়াত ও ইসলামি গানের অনুষ্ঠান করছে। কে দাওয়াত করেছেন, তাঁর সুন্দর ও মোবারক নামটি লিখি? প্রিয়জন হামিদুল ইসলাম।
তা
মাগরিবের পরে রওয়ানা দিলাম। অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে বাদে আসর। অনুষ্ঠান কোথায় হচ্ছে জানেন? বসুন্ধরা কনভেনশন সেন্টার। এটাও একটা উল্লেখযোগ্য মাইলফলক। হুজুররা দেশের সেরা সেন্টারে অনুষ্ঠান করে দেখাচ্ছে। আমার খুশি খুশি লাগছে। যদিও সুরত, সীরত ও জিবল্লতে আমি আলিম নই। কেন জানি, আলিমদের ভালো লাগে। খুউব ভালো লাগে। ভীষণ ভালো লাগে।
আমি বসুন্ধরা কনভেনশন সেন্টারে কখনো যাই নি। কোথাও ত যাই না। কুড়িল চৌরাস্তা থেকে রিকশা নিয়ে যাচ্ছি। সুনসান নিরব সড়ক। কোথাও সরকারি বাত্তি জ্বলছে না। এখন ঢাকাশহরে প্রায় ছিনতাই ও খুন খারাপি হচ্ছে। পুলিশও নেই। ধেত্তেরি! আমি সামান্যতে বিরক্ত হই। বিরস বদনে কনভেনশন সেন্টারের গেটে পৌঁছলাম। হামিদ ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করে জানলাম, তিন নম্বর হলরুমে অনুষ্ঠান। এক নম্বর হলরুম থেকে বিকটস্বরে হিন্দি বাজনা আসছে, গান দুর্বোধ্য।
হামিদ ভাই এসে নিয়ে গেল ভেতরে। মানুষ ও মানুষ। টিকেট প্রদর্শন করে ঢুকতে হল। এটাও ভালো লেগেছে। আলিমদের অনুষ্ঠান মাগনা উপভোগের জমানা শেষ। আলহামদুলিল্লাহ্।
সব মানুষ ইসলামি পোশাক পরা। একটা নুরানি আবহাওয়া তরতর করে বয়ে বেড়াচ্ছে। হলটা বিশাল, বিপুল মানুষ। সবার মুখ থেকে ঈমানি আভা বের হচ্ছে। দাড়ি, পাগড়ি ও মিষ্টি হাসি প্রায় সকলকে সুশ্রী করে প্রভা ছড়াচ্ছে। আমিই সম্ভবত সবচেয়ে বদনসিব এখানে। আমার কিচ্ছু ঠিক নেই। কিচ্ছু না।
হামিদ এক জায়গায় বসানের চেষ্টা করছে। সীট খালি নেই। কানায় কানায় ভর্তি। ভালো লাগছে। অন্যরকম ভালো লাগা। বুঝাতে পারব না। আমার খুব ভালো লাগলে, বুঝাতে পারি না। খুব খারাপ লাগলে? তাও না। এখন অতিরিক্ত ভালো লাগছে।
হামিদ কলরবের সাঈদ আহমদ সাহেবের সাথে পরিচয় করালেন। আগে থেকে তার সাথে ফেসবুকে আলাপ হয়েছে। এখন সাক্ষাত হল। মোয়ানাক্বা হল তাঁর সাথে। মোয়ানাক্বা আনকা আনকা লাগছে? গলায় মেলানো আর কি! এটা সম্ভবত সুন্নত। ইউরোপীয়রা এটা ইসলাম থেকে শিখেছে।
পেছনে গ্যালারি মতো জায়গা। সেখানে পরিপাটি ও নিরব হয়ে মেয়েরা বসে অনুষ্ঠান উপভোগ করছে। এ আয়োজনকে আপনি কী ভাষায় প্রশংসা করবেন? আমার মন উতলা হয়ে কলরবের বরকতের জন্য দুআ এসেছে। কলরব পর্দানশিন নারীর কথাও ভাবে? মাশাআল্লাহ!
ছা
তখন অনুষ্ঠানে একটা হামদ চলছে। কোরাস গান। হামদ মানে? আল্লাহ তায়ালার শ্লাঘাসমেত গান। সুন্দর। কথা, সুর ও গায়কী সব সুন্দর।
তারপর অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথির নাম ঘোষণা হল। চরমোনাইর মুহতারাম পীর ফয়জুল করিম সাহেব। আমি কখনো তাঁর বয়ান বা বক্তৃতায় শুনি নি। ইউটিউবেও না। এটা আমার বদবখতির দলিল। তাঁর আব্বাজান মরহুমের আলোচনা শুনেছি চকরিয়ার প্রত্যন্ত এক গ্রামে। শীতার্ত রাতে। বেতুয়া বাজার নামের এক অজপাড়াগাঁকে তিনি ঝংকৃত ও অলংকৃত করেছিলেন। আলহামদুলিল্লাহ্। তাঁর নুরানি বয়ান আমার মনে এখনো সজীব। একেবারে হেদায়তি বয়ান ছিল।
চরমোনাই হযরত মঞ্চে এলেন। তরুণ আলিম। সাত মিনিট কথা বললেন। হযরতের বয়ান আছে, গুলবাগে। তাই চলে গেলেন। সাত মিনিটে যা বলেছেন, আলহামদুলিল্লাহ্ আমার ভালো লেগেছে। উদ্দীপ্ত ও তৃপ্ত কথা বলেছেন। উচ্চারণ ছিল বলিষ্ঠ। কথাবার্তা ছিল সুনির্দিষ্ট। প্রথম দর্শনে তাঁকে ভালো লেগেছে। তাঁর রূহানিয়্যত জ্বলজ্বলে, এরকম মনে হল। একেবারে সাদামাটা এলেন, সরলতার সাথে গেলেন।
এটা আলোড়িত করেছে। মাশাআল্লাহ!
তারপর কুরআন মজিদের সুললিত তেলাওয়াত। যিয়াদ আলজযায়েরি মানে আলজেরীয় যিয়াদ অনেক্ষণ তেলাওয়াত করলেন। মরুহম আব্দুল বাসিতের স্টাইলে তেলাওয়াত বেশ উপভোগ্য হল। আল্লাহু আকবারের মূর্ছনায় মাহফিলে কোরাস হল, বারবার।
তারপর, সংগীতসুধায় বারবার বিভোর হলাম। কখনো একক গীত। কখনো যৌগ সংগীত। কখনোবা কোরাস সংগীত। সবি সুন্দর। মনোহর। মনোজ্ঞ। মঞ্জুল। মনোজ। আলহামদুলিল্লাহ্।
খ্যাতিমান কবি, সাহিত্যিক সাইফ সিরাজ সাহেবের, হাসবি রাব্বি জাল্লাল্লাহ, অপরূপ লেগেছে। এখনো কানে ও হৃদয়ে বেজে চলেছে। এতো মনকাড়া কথা! এমন প্রাণজুড়নো সুর! ও কলরবের এমন ক্বলব ছোঁয়া সুর! মাদকতা এসে অনুভূতি মাতাল করে। বিশেষ শুকরান, কবি সাইফ সিরাজকে।
উর্দু নাআাতও শুনলাম। চেতনার গীতিতে মগ্ন হলাম। আইনুদ্দিনের বিখ্যাত কী হবে, গান আছে না? শুনলাম।
আবু রাইহানের জাদুকরি কণ্ঠস্বরের সুরসুধা পেলাম। ক্বাওয়ালিও শুনলাম। এককথায় তো বলা যায় না। তবু, বললে, বলতে হয়, সর্বাঙ্গীণ ও সর্বজনীন সরসী নিয়ে এসেছিল কলরব। কলরবকে মোবারকবাদ।
সবচেয়ে ভালো লাগা সংগীত বাছাই করা সংগিন। আমার কাছে সবচেয়ে ভালো লেগেছে প্রিয় সাঈদ আমহদ ভাই এর গাওয়া একটি পুরনো গান। আজাদ মরহুমের সংগীত। যদি জীবনকে বিলাতে চাও? গানটি।
আবেদন, আবেশ, আমগ্নতা, আপ্লাবন সবি ছিল সাঈদ ভাইয়ের গলায়। আল্লাহ তাঁকে নেক হায়াত দান করুন। তাঁকে আমার বেশ সমঝদার ও দীনদার মনে হল।
মাঝে ইরানি এক ক্বারি সুরের লহরি ও সুখের কল্লোল তুলেছেন, বারংবার। আবিষ্ট পুরো মজমা। আমি ত বু্ঁদ।
একেবারে শেষে, একটু চমকালাম। মঞ্চে এলেন চলচ্চিত্রের শক্তিশালী খলনায়ক মিশা সওদাগর।
চক্ষু চড়কগাছ! তাঁর বিনয়াবনত কথাবার্তা ইউটিউবে এসেছে, শুনুন! প্রাণে সুখের ঘাস জন্মাবে।
কেমন দয়া ও দরদ ভরে তিনি ইসলাম, আলিম ও দীনদারদের ক্বদর করলেন! বুঝাতে পারব না। লোকটি এতো সজ্জন ও অভিজাত ভদ্র কেন?
আল্লাহ তাঁকে পূর্ণ হেদায়ত আতা’ করুন। আমিন!
জিম
অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার আগেভাগে বের হচ্ছি। আমার হুলুস্থুল জটলা ভালো লাগে না। শ্রদ্ধেয় সাঈদ ও প্রিয় হামিদের কাছ থেকে বিদায় নিলাম। আসলেই বিদায় নিলাম? সম্ভবত না। তাঁদের সমীহ ও সহৃদয়তায় রয়ে গেলাম।
এই মাহফিল আমাকে অজস্র অফুরান খোরাক দিয়েছে। বহুদিন পর রূহ প্রশান্তি পেল। আত্মার ক্লান্তি দূর হল।
সমুদ্ভাসিত সম্ভাবনার মায়াবি পর্দা দুলে উঠল। আশাবাদী পানকৌড়ির দল আমাকে প্রাণিত ও শাণিত করল।
ইয়া রব! সকল শোকর তোমার তরে।
হামিদের সৌজন্যে এতো বড় উপলক্ষের উপহার পেলাম। শুধু জাযাকাল্লাহ বললে হবে না। তাঁর আরো হক আদায় করতে হবে। ইনশাআল্লাহ।
বাসে। বাসায় ফিরছি। ঠাণ্ডা সমীরণে কাঁপছি। অপরাধবোধ ও দীনি বোঝও আমাকে প্রস্ফুরিত করছে।
ইলাহি! আমার হেদায়তের সূর্য গোলাব কবে উঠবে? মিশমিশে কালো আঁধার আর ভালো লাগে না!!!
নোটিশ: আপনি কি ব্লগ কিংবা ফেসবুকে ইসলাম এবং সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয়ে লেখালেখি করতে আগ্রহী? তাহলে আপনার লেখা পাঠিয়ে দিন আমাদের কাছে।বিস্তারিত তথ্যের জন্য আমাদের ফেসবুক পেজে মেসেজ দিন। ধন্যবাদ Fb.com/MaqamaeIbrahim
Copyright©2017: IslaameraloII Design By:F.A.CREATIVE FIRM