গীবত বা পরনিন্দাচর্চা:
গীবত বা পরনিন্দাচর্চার ব্যাপকতা আজকাল সমাজে প্রকট আকার ধারণ করেছে। যার কারণে বেশির ভাগ মানুষকে প্রায়ই পরনিন্দাচর্চার মতো জঘন্য পাপাচারে লিপ্ত থাকতে দেখা যায়। অবস্থাদৃষ্টে দেখা যায় আমরা প্রায় কেউই গীবতের আপদ থেকে মুক্ত নই। গীবত এমনই একটি ঘৃণিত স্বভাব যা থেকে সহজে পরিত্রাণ পাওয়া যায় না। আর শয়তানের প্ররোচনায় মানুষ এর প্রতি এতটাই ঝুঁকে পড়ে, যে গীবত করে তার কাছে তা যেমন খুব ভালো লাগে আর যারা শোনে তাদের কাছেও তা আরো বেশী ভালো লাগে। তবে মহান রাব্বুল আলামীন তাঁর স্বীয় অনুগ্রহে যাকে এই আপদ থেকে রক্ষা করেন, সে ব্যক্তিই কেবল রক্ষা পেতে পারে।
গীবতের ক্ষতি বড় কঠিন। কারণ, গীবত মানবসমাজে পরস্পরের মধ্যে হিংসাবিদ্বেষ, ঘৃণা ও মনোমালিন্যের সৃষ্টি করে। এ কারণে পবিত্র কুরআন ও হাদীসে অত্যন্ত কঠোর ভাষায় গিবতের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা উচ্চারিত হয়েছে।
গীবত এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে:
অপবাদ, অসাক্ষাতে নিন্দা, কুৎসা রটনা, কলঙ্ক রটনা, কারো চরিত্র হননের জন্য বিবৃতি দেওয়া ইত্যাদি।
ইসলামি পরিভাষায় গীবত হচ্ছে:
কারো সম্বন্ধে তার অনুপস্থিতিতে এমন কোনো কথা বলা, যা শুনলে অপ্রিয় মনে হবে।
অপরের দোষের দিকে দৃষ্টি রেখে যে কথা বলা হয়, তাই গীবত।
গীবতের পরিণতি:
গীবতের পরিণতি এবং তার শাস্তি সম্পর্কে আয়াতে কুআান ও হাদীসে রাসুল (সাঃ) এর দ্বারা অসখ্য প্রমানাদী রয়েছে,তার মধ্যে দু’একটি সংক্ষেপে আয়াত ও হাদীস বর্ণনা করতে সক্ষম হয়েছি।
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اجْتَنِبُوا كَثِيرًا مِّنَ الظَّنِّ إِنَّ بَعْضَ الظَّنِّ إِثْمٌ ۖ وَلَا تَجَسَّسُوا وَلَا يَغْتَب بَّعْضُكُم بَعْضًا ۚ أَيُحِبُّ أَحَدُكُمْ أَن يَأْكُلَ لَحْمَ أَخِيهِ مَيْتًا فَكَرِهْتُمُوهُ ۚ وَاتَّقُوا اللَّهَ ۚ إِنَّ اللَّهَ تَوَّابٌ رَّحِيمٌ ..
হে মুমেনগণ! তোমরা বহুবিধ অনুমান হতে দূরে থাকো, কারণ অনুমান কোন ক্ষেত্রে পাপ এবং তোমরা একে অপরের গোপনীয় বিষয় অনুসন্ধান কর না, এবং একে অপরের পশ্চাতে নিন্দা করো না, তোমাদের মধ্যে কি কেউ তার মৃত ভাইয়ের গোশ্ত ভক্ষণ করতে ভালবাসবে ? বস্তুতঃ তোমরা এটাকে ঘৃণাই মনে কর। তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। আল্লাহ তাওবা গ্রহণকারী। পরম দয়ালু। (সুরা হুজরাত)
قَالَ : قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : ” إِيَّاكُمْ وَالْغِيبَةَ فَإِنَّ الْغِيبَةَ أَشَدُّ مِنَ الزِّنَا ” ، قَالُوا : يَا رَسُولَ اللَّهِ , وَكَيْفَ الْغِيبَةُ أَشَدُّ مِنَ الزِّنَا ؟ قَالَ : ” إِنَّ الرَّجُلَ قَدْ يَزْنِي , ثُمَّ يَتُوبُ فَيَتُوبُ اللَّهُ عَلَيْهِ ، وَإِنَّ صَاحِبَ الْغِيبَةِ لا يُغْفَرُ لَهُ حَتَّى يَغْفِرَ لَهُ صَاحِبُهُ ” .
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমরা গীবতচর্চা থেকে দূরে থাকো কেননা, গীবত জেনার (ব্যাভিচার) চেয়েও মারাত্মক।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তাঁর সাহাবিরা জিজ্ঞেস করেছিলেন, হে আল্লাহর রাসুল! গীবত কি জেনার চেয়েও মারাত্মক? জবাবে তিনি বললেন, হ্যাঁ, কারণ কোনো ব্যক্তি জেনার পর (বিশুদ্ধ) তওবা করলে আল্লাহ ক্ষমা করেন। কিন্তু গীবতকারীকে যার গীবত করা হয়েছে, তিনি মাফ না করলে আল্লাহ মাফ করবেন না। (মুসলিম)
كما قال صلى الله عليه وسلم: لما عرج بي مررت بقوم لهم أظفار من نحاس يخمشون وجوههم وصدورهم، فقلت من هؤلاء يا جبريل؟ قال: هؤلاء الذين يأكلون لحوم الناس ويقعون في أعراضهم. رواه أبو داود ومعناه أيضاً في مسند الإمام أحمد
গীবতের শাস্তি সম্পর্কে আবু দাউদে হযরত আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : মিরাজের রাতে যখন আসমানের ওপর গমন করি, তখন এমন কিছু লোকের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম যারা তাদের চেহারা ও মুখমণ্ডল তাদের নখ দিয়ে (কোনো কোনো রেওয়ায়েতে তাদের নখ ছিল তামার) আঁচড়াতে ছিল। তখন আমি জিজ্ঞেস করি, হে জিব্রাইল! এরা কারা? তিনি বলেন, এরা তারা যারা দুনিয়াতে অন্য লোকের গোশ্ত ভক্ষণ করত (অর্থাৎ গীবত করত) এবং মানুষের ইজ্জত নষ্ট করত।
সব ধরনের অশ্লীলতা ও অশালীন উক্তি ইসলামে নিষিদ্ধ। যে কথা শুনে মানুষ কষ্ট পায়, তাই অশালীন। কারো সম্পর্কে অপ্রীতিকর বাক্য না বলাই হচ্ছে শালীনতা।
ইসলামের আগমন হয়েছে মানুষকে শালীনতা ও সৌহার্দ্য শিক্ষা দেওয়ার জন্য। তাই শালীনতাকে ইসলাম মানুষের মর্যাদার মাপকাঠি হিসাবেও নির্ধারণ করেছে। অর্থাৎ যে যতো বেশি শালীন সে ততো বেশি মর্যাদাবান।
পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে- ‘আল্লাহ তা’আলার নিকট ওই ব্যক্তি বেশি মর্যাদাবান যে বেশি শালীন ও পরহেযগার।’
গীবত সম্পর্কে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর যেসব হাদীস রয়েছে এগুলোর মর্ম হচ্ছে ‘যা সম্মুখে বললে মনে বিরক্তি ও কষ্ট আসে, অগোচরে তা বলাই গীবত।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন : তোমরা অপরের গীবত করা থেকে সর্বদা নিজেকে বাঁচাতে চেষ্টা করো। কারণ, গীবতের ভেতর তিনটি মারাত্মক আপদ রয়েছে, (এক) গীবতকারী ব্যক্তির দোয়া কবুল হয় না। (দুই) তার কোনো নেক আমল আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হয় না। (তিন) তাকে অসংখ্য পাপরাশির বোঝা বহন করতে হয়। (মুকাশাফাতুল কুলুব)
গীবতের পরিণতি প্রসঙ্গে হাদীসে কুদসীতে এসেছে : নিশ্চয়ই কিয়ামতের দিন বান্দাকে তার আমলনামা খোলা অবস্থায় দেয়া হবে। সে তাতে এমন কতগুলো নেকী দেখবে যা সে আমল করেনি। সে বলবে : হে প্রভু! আমি এই নেকীগুলো অর্জন করিনি। তিনি বলবেন : লোকেরা তোমার নিন্দা করেছিল, তারই বদলে আমি এগুলো লিপিবদ্ধ করেছি। অপর এক বান্দার সামনে কিয়ামতের দিন তার আমলনামা খুলে দেয়া হবে। সে বলবে : হে প্রভু! আমি কি অমুক দিন অমুক পুণ্য করিনি? তখন তাকে বলা হবে, তুমি লোকদের নিন্দা করতে। ফলে সেসব পুণ্য তোমার আমলনামা হতে মুছে ফেলা হয়েছে।
গীবত থেকে বাঁচার উপায়:
গীবতের পাপ ও শাস্তি থেকে বাঁচার উপায় হল, তওবা করা এবং যার গীবত করা হয়েছে, তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা।
হযরত আনাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন যে, রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন: নিশ্চয় গীবতের কাফ্ফারা হলো তুমি যার গীবত করেছ, তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করবে। তুমি এভাবে বলবে, হে আল্লাহ আমাদেরকে এবং তাকে ক্ষমা করে দাও। [বায়হাকী]
সবসময় নিজের দোষ ত্রুটির কথা চিন্তা করা : কারণ নিজের ত্রুটির কথা স্মরণ থাকলে, অন্যের চেয়ে নিজেকেই ছোট মনে হবে এবং অন্যের সমালোচনা করার কথা মাথায় আসবেনা।
এক হাদিসে রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন: সুসংবাদ ওই ব্যক্তির জন্য যার নিজের ত্রুটি তাকে অন্যের দোষ-ত্রুটি দেখা থেকে বিরত রেখেছে।
কোন কোন ক্ষেত্রে গীবত জায়েয বরং ওযাজিব: কিছু কিছু ক্ষেত্রে গীবত করা জায়েয আছে।
যেমন-
জুলুমের প্রতিকার পাবার জন্য:
যদি কেউ কারো উপর জুলুম করে, তাহলে মাজলুম ব্যক্তি জালেমের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট তার জুলুমের প্রতিকার পাবার জন্য দোষ বর্ণনা করা জায়েয আছে।
অতএব, কালবিলম্ব না করে আসুন আল্লাহর নিকট খালিস নিয়তে তাওবা করে গীবত নামক ঘৃণিত স্বভাবের আপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করি।
আল্লাহ আমাদেরকে গীবত থেকে বেচেঁ থাকার তাওফীক দান করুন। আমীন…
লিখক:- নাসরুল্লাহ ওমরী
ছাত্র:- মদিনা ইউনিভার্সিটি ইসলামী শারিয়াহ্ আইন ও বিচার বিভাগ
নোটিশ: আপনি কি ব্লগ কিংবা ফেসবুকে ইসলাম এবং সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয়ে লেখালেখি করতে আগ্রহী? তাহলে আপনার লেখা পাঠিয়ে দিন আমাদের কাছে।বিস্তারিত তথ্যের জন্য আমাদের ফেসবুক পেজে মেসেজ দিন। ধন্যবাদ Fb.com/MaqamaeIbrahim
Copyright©2017: IslaameraloII Design By:F.A.CREATIVE FIRM