আত্মিক শক্তি: ক্ষমতার উৎস!
রাকিব হাছান
বন্দুকের নলই সকল ক্ষমতার উৎস। চীনের মাওসেতুংয়ের বিখ্যাত উক্তি। উক্তিটা শতভাগ সঠিক না হলেও, মোটামুটি সঠিক। না না, আমরা মাওবাদ নিয়ে আলোচনায় বসিনি! আমরা মুসা ও হারুন আ.-এর বিশেষ একটি দিক নিয়ে কথা বলব। ইনশাআল্লাহ!
(১): মুসা আ. শক্তিমান পুরুষ ছিলেন। প্রচণ্ড দাপট ছিল তাঁর। দৃঢ় ব্যক্তিত্বের অধিকারী নবী ছিলেন। রাশভারী ব্যক্তিত্বের কারণে আশেপাশের সবাই তাকে সমীহ করে চলত। রেসালতের দায়িত্ব এল আল্লাহর পক্ষ থেকে। এত শক্তিমান হওয়া সত্বেও আল্লাহর কাছে সহকারির আবেদন জানালেন। এই গুরুদায়িত্ব একা একা পালন করা কঠিন। (وَأَخِي هَارُونُ) আমার ভাই হারুন!
هُوَ أَفْصَحُ مِنِّي لِسَانًا
সে আমার চেয়েও স্পষ্টভাষী।
فَأَرْسِلْهُ مَعِيَ رِدْءًا يُصَدِّقُنِي ۖ
তাকেও আমার সঙ্গে আমার সাহায্যকারীরূপে পাঠিয়ে দিন, যাতে সে আমার সমর্থন করে।
إِنِّي أَخَافُ أَن يُكَذِّبُونِ
আমার আশঙ্কা, তারা আমাকে মিথ্যাবাদী বলবে (কাসাস ৩৪)।
(২): মুসা আ.-এর তুলনায়, হারুন আ. ছিলেন কিছুটা নরম প্রকৃতির। শক্তপোক্ত ব্যক্তিরও নরমসরম সহযোগী দরকার হয়। প্রবল কঠোর ব্যক্তিত্বের অধিকারীর আশেপাশে কিছু নরম মানুষ থাকা দরকার। তারা গরম কথাগুলোকে নরম ভাষায় বুঝিয়ে দেবে। হারুন আ.-এর ভূমিকাও অনেকটা তাই। তিনি মুসার চিন্তাকে বিশুদ্ধ ভাষায়, উত্তম পদ্ধতিতে, আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে, গুছিয়ে সবার কাছে পৌঁছে দেবেন।
মুসা আশঙ্কা করেছিলেন, তিনি হয়তো রেসালতের বাণী যথাযথভাবে ফেরআওনের কাছে ব্যক্ত করতে পারবেন না। তাই ভাইকে সাহায্যকারী হিশেবে চেয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা আদেশ করেছিলন, ফেরআওনের কাছে দাওয়াত নিয়ে যেতে। তার প্রেক্ষিতে মুসা সাহায্য চেয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা আবেদন মঞ্জুর করে বলেছেন,
سَنَشُدُّ عَضُدَكَ بِأَخِيكَ
আমি তোমার ভাইয়ের দ্বারা তোমার বাহু শক্তিশালী করে দিচ্ছি (৩৫)।
(৩): দুই ভাই গেলেন রাজদরবারে। কথোপকথন শুরু হল। কুরআন কারীমে কথোপকথনটা আছে। সূরা ত্বহা ও শু‘আরাতে কথোপকথনটা দেখে নিতে পারি। পুরো আলোচনার কোথাও হারুনের উপস্থিতি বোঝা গেল না। ফেরআওনের সাথে কথা যা বলার মুসাই বললেন। অথচ তিনি (হারুন) সাথেই ছিলেন। এবং অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়েছে, তাকে আনাও হয়েছিল মুসার পক্ষ থেকে কথোপথন চালানোর জন্যে। মুসা আ. যেভাবে স্বতঃস্ফূর্তভাবে কথা চালিয়ে গেছেন, তাতেই ফেরআওন ভড়কে গেছে। মাঝেমধ্যে প্রচ- রেগেও গিয়েছে। কখনো কথার খেই হারিয়ে ফেলেছে। কখনো উত্তর খুঁজে পায়নি। রীতিমতো লেজেগোবরে অবস্থা হয়েছে ফেরআওনের।
(৪): প্রশ্ন হল, হারুন আ.-এর ভূমিকা কী ছিল? হারুন ছিলেন (دعم معنوي) আত্মিক সমর্থন যোগানো। মেন্টাল সাপোর্টও বলতে পারি। একজন ভাই ও ভাষাবিদ সাথে থাকার কারনে, মুসার মনোবল নিশ্চয়ই অনেক বেড়ে গিয়েছিল। জালিমের সামনে বুকচিতিয়ে দাঁড়ানোর হিম্মত বৃদ্ধি পেয়েছিল।
(৫): আত্মিক শক্তিটা হেলাফেলার বিষয় নয়। এই একটা ব্যাপার, যতবড় শক্তিশালীই হোক, তারও মেন্টাল সাপোর্ট লাগে। সেটা হতে পারে ভাই বা বিবি বা মা-বাবা বা অন্য কেউ, অন্য কিছু। এই শক্তিটা হয় কোমল! নরম! কমনীয়! নমনীয়! এটা থেকে শক্তিমান পক্ষ লড়াইয়ের শক্তি (এনার্জি) অর্জন করে। প্রেরণা লাভ করে। মনোবল হাসিল করে। মানসিক স্বস্তি অনুভব করে। মুসা আ.ও ভাইয়ের সঙ্গ থেকে মনোবল অর্জন করেছিলেন।
(৬): পৃথিবীর সমস্ত সেনাবাহিনীতেই (Department of Morale Affairs) বিভাগ থাকে। সৈন্যদের নীতি-নৈতিকতা ও মনোবল চাঙ্গা রাখা এই বিভাগের মূল দায়িত্ব। আরবীতে একে আমরা বলতে পারি (هيئة الشؤون المعنوية)। প্রাচীন কাল থেকেই প্রতিটি সেনাবাহিনীতে এই বিভাগ অত্যন্ত গুরুত্ব ও তৎপরতার সাথে কাজ করে এসেছে।
ক: বদর যুদ্ধের দিকে খেয়াল করলে দেখতে পাব, আবু জাহল অত্যন্ত জ¦ালাময়ী ভাষায় বক্তব্য দিয়ে কুরাইশ যোদ্ধাদেরকে উস্কে দিয়েছে। পেছন থেকে নারী নর্তকীরা তো অনবরত গান গেয়ে, ঢোল-তবলা পিটিয়ে উত্তেজনা বৃদ্ধি করে গেছে। ওহুদে কি হল? এই বিভাগের দায়িত্ব নিজ হাতে তুলে নিল স্বয়ং প্রধান সেনাপতি আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দা। এই মহিলা যে জোশ আর অভিব্যক্তি দিয়ে অপূর্ব ছন্দোবদ্ধ কবিতা আবৃত্তি করেছিল, তা পড়ে (ও এক সিরিজে শুনে) এই অধমের রক্তও গরম হয়ে গিয়েছিল। কুরাইশরাও ইসলামবিরোধী সমরে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে Department of Morale Affairs এর কার্যক্রম চালু রাখতো। খন্দকেও একই ঘটনা। আর হুনাইনে কাফির দলের সেনাপতি মালিক যা খেল দেখিয়েছিল, সে আলাপের সুযোগ এখানে নেই।
খ: আর মুসলমানদের মধ্যে কি এই ‘ডিপার্টমেন্ট’ ছিল? ছিল না মানে, আলবৎ ছিল। স্বয়ং নবীজি সা. এই বিভাগের দায়িত্ব সুচারুরূপে পালন করেছেন। তার একেকটি কথা, একেকটি ইশারাই সাহাবায়ে কেরামকে তাতিয়ে দেয়ার জন্যে যথেষ্ট ছিল। বলতে কেমন শোনায় বলতে পারছি না। ভয়ে ভয়ে বলেই ফেলি, বদরে-ওহুদে, নবীজীবনের সমস্ত যুদ্ধে, Department of Morale Affairs-এর দায়িত্ব সরাসরি আল্লাহ তা‘আলার কুদরতি হাতেই ছিল। বদরের দিকে একটু লক্ষ্য করি! যুদ্ধের প্রতিটি স্তরে আল্লাহ তা‘আলা জিবরাঈলের মারফতে আয়াত নাযিল করেছেন। একটি আয়াত আসে, হুজুর সা. তিলাওয়াত করেন, আর সাহাবায়ে কেরামের মনোবল পাহাড়চুম্বী হয়ে ওঠে। কাদেসিয়া, ইয়ারমুক, মুতার ঘটনা সবার সামনেই আছে। এসব ময়দানে, সেনাপতি ও খতীবগনের জ¦ালামীয় খোতবা মুজাহিদ বাহিনীর মনোবল বহুগুণ বৃদ্ধি করে দিয়েছিল।
গ: কেউ কেউ বলে সীরাত পড়ে মজা পায় না। যুদ্ধগুলোর বিবরণ পড়ে কোনও রসকষ পায় না। অবাক লাগে, গল্পের বইয়ের মতো গড়গড় করে পড়লে মজা লাগবে কোত্থেকে? ঈমান ও কুফর উভয় পক্ষের প্রতিটি নড়াচড়াকে বিশ্লেষণ করে করে পড়লে, অন্য কিছু পড়তেই তো ইচ্ছা না হওয়ার কথা!
ঘ: অতীতে ও বর্তমানে, ময়দানে দু’টি পক্ষ থাকে। ঈমানের দল ও কুফরের দল। দুই দলের বিভাগীয় কর্মপদ্ধতিতে অনেক তফাৎ থাকে। কুফরপক্ষের কার্যক্রমে মিথ্যা আশা, ধোঁকা আর পাপ জড়িয়ে থাকে। হালের ইরাক সিরিয়ার দিকেই দেখি না। কুফর পক্ষ কী করে? কোনও একটা শহর সামান্য দখল করতে পারলেই, মিডিয়ার ফলাও করে প্রচার শুরু করে দেয়, পুরো শহরই দখল হয়ে গেছে। এতে তাদের লাভ হয়! তাদের সৈন্যদের মনোবল চাঙ্গা হয়ে ওঠে। মসুলে, রাক্কায় আরও শহরগুলোতে আমরা ব্যাপারটা লক্ষ্য করেছি।
ঙ: আপরদিকে ঈমানের পক্ষও নাশীদ, বিভিন্ন ভিডিও প্রচার করে নিজ সমর্থকদের মনোবল চাঙ্গা রাখার প্রয়াস পায়। কুরআন হাদীসপূর্ণ বক্তব্য প্রচার করে।
(৭): ফেরআওনের কাছে দাওয়াত নিয়ে যাওয়া, মুসা ও হারুন আ.-এর জন্যে ছিল যুদ্ধ। স্নায়ুযুদ্ধ। এই যুদ্ধে ‘তনোবলের’ চেয়ে মনোবলের ভূমিকা বেশি ছিল। হারুন আ.-এর উপস্থিতিই Department of Morale Affairs-এর কাজ করেছিল।
(৮): তবে, ‘ডিপার্টম্যান্ট মোরাল এফেয়ার’ কার্যকর আর সক্রিয় ভূমিকা পালন করার পূর্বশর্ত হল, মূল ‘ডিপার্টম্যান্ট’ শক্তিশালী হওয়া। মূলনেতৃত্ব শক্তিশালী হওয়া। মুসা আ. শক্তিশালী না হলে, শত ‘হারুন’ দিয়েও কোনও কাজ হবে না।
(৯): খেলাধূলাতেও দেখি, গ্যালারিতে দর্শক বা প্রিয়জনের উপস্থিতি খেলোয়াড়কে চাঙ্গা করে। খেলোয়াড়ের যদি যোগ্যতাই না থাকে, তার স্কুলজীবন থেকে শুরু করে, ভার্সিটি জীবন পর্যন্ত যত মেয়ের দিকে পাপপূর্ণ লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়েছে, তাদের সবাইকে বধুবেশে হাজির করলেও, কিছু হবে না। নৈতিক সমর্থন বড়জোর সাময়িক ‘তোড়’ সৃষ্টি করতে পারে। মূল শক্তি নিজের কাছেই থাকতে হয়। মুসা আ.-এর মধ্যে, আমাদের নবীজি সা.-এর মধ্যে এই শক্তি পরিপূর্ণভাবে বিদ্যমান ছিল।
(১০): বাহ্যিক সমর্থন, অতিরিক্ত প্রাপ্তির আশ্বাস যোদ্ধাকে একটু জাগিয়ে দেয়। আরও কিছুটা সময় তাকে লড়াই চালিয়ে যেতে প্রেরণা দেয়। তাকে চূড়ান্ত বিজয়ী করে তোলে না। সেনাপতির মৃত্যুর ব্যাপারটার দিকে তাকালে বিষয়টা বোঝা যায়। অথচ সেনাপতিও সৈন্যদের মতোই একজন সেনা। তার মৃত্যুতে একজন লোকের পরিমাণ কমে শুধু। কিন্তু তারপরও সেনাপতির মৃত্যুর খবর চাউর হওয়ার সাথে সাথে, পুরো সেনাদল ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। কাদেসিয়ার জিহাদে আমরা যেটা দেখতে পেয়েছি। রুস্তম ‘কাত’ হওয়ার সাথে সাথে অপরাজেয় ‘পারস্য’ বাহিনী ‘সাফা’। সেই পরাজয়ের কষ্ট পারস্যবাসী আজ পর্যন্ত ভুলতে পারেনি। এটা কেন হয়? কারণ হল, সেনাপত্রি শুধু মূলশক্তিই নয়, একটা দলের সেনাপতি তার দলের সদস্যদের কাছে ‘মোরাল’ আইকনও বটে। একজন সেনাপতি পুরো দলের শক্তির প্রতীক। ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু। ভরকেন্দ্র। এজন্যই দেখা যায়, কিছুদিন পরপরই, পাশ্চাত্য মিডিয়াতে খবর বেরোয়, অমুক সন্ত্রাসী নেতা মারা গেছে। অবশ্য তাদের এই প্রোপাগাণ্ডা যুদ্ধ খুব একটা কাজে আসে না।
(১১): আমরা ‘মোরাল’ ডিপার্টম্যান্টের দিকেই শুধু লক্ষ্য রাখব না। মূল বিভাগের দিকেও লক্ষ্য রাখব। মনে রাখতে হবে, হারুন নয়, মুসা আ.-ই মূলশক্তি। মুসা ছাড়া হারুন অচল। বাস্তবেও তাই দেখা গেছে। মুসা আ. আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের জনে তুরপাহাড়ে গেলেন। হারুনকে দায়িত্ব দিয়ে গেলেন কওমের। মুসা বেরিয়ে যেতে না যেতেই বেশিরভাগ বনী ইসরাঈল ‘গোবৎস-পূজা’ শুরু করে দিল। হারুন আ. শতচেষ্টা করেও এই শিরকি কর্মকাণ্ড রোধ করতে পারলেন না।
(১২): বনী ইসরাঈল কিছুদিন আগেই বিরাট বড় বড় মুজিযা দেখেছে। সাগর দ্বিখণ্ডিত হওয়া, ফেরআওনের মৃত্যু, বারোটি প্রস্রবণ আরও আরও মুজিযা। কিন্তু দুষ্টলোকগুলো মুসা আড়াল হওয়ার সাথে সাথে সব ভুলে গেল। হারুন আ. বাধা দিতে গেলে তাকে প্রায় মেরেই ফেলেছিল আরকি। মুসা আ. ফিরে এলে, হারুন আ. প্রকৃত চিত্রটা তুলে ধরেছিলেন,
إِنَّ الْقَوْمَ اسْتَضْعَفُونِي وَكَادُوا يَقْتُلُونَنِي
বিশ্বাস কর, লোকজন আমাকে দুর্বল মনে করেছিল এবং আমাকে প্রায় হত্যা করেই ফেলেছিল (আ‘রাফ১৫০)।
(১৩): দুষ্ট বনি ইসরাঈল নবী হারুনকে মানল না। একগুঁয়েমী করে বলল,
لَن نَّبْرَحَ عَلَيْهِ عَاكِفِينَ حَتَّىٰ يَرْجِعَ إِلَيْنَا مُوسَىٰ
যতক্ষণ পর্যন্ত মূসা ফিরে না আসেন, আমরা এর (গো-বৎসের) পূজায় রত থাকব (তোয়াহা ৯১)।
মুসা ফিরে এলেন তুরপাহাড় থেকে। এরপরের ঘটনা একেবারে সংক্ষিপ্ত। মুসা সবকিছু দেখলেন। বিভিন্ন পক্ষের কথা শুনলেন। প্রকৃত অবস্থা বুঝতে পারলেন। গো-বৎসটাকে পুড়িয়ে ছাইভস্ম উড়িয়ে ফেলার কড়া নির্দেশ জারি করলেন। গো-বৎসের মূলহোতাকে ধরে এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিলেন। গো-পূজারী হাজার হাজার বনী ইসরাঈলের একজনের মুখ দিয়ে টুঁ-শব্দটিও বের হল না। অথচ এর আগে, হারুন আ.কে তারা মেরে ফেলতে উদ্যত হয়েছিল।
(১৪): হারুন বিশুদ্ধভাষার অধিকারী! মুসার দাওয়াতী কাজের প্রধান সহযোগী! কিন্তু এসব কোনও কাজে এল না। শক্তিমান না হলে, দৃঢ় ব্যক্তিত্বের অধিকারী না হলে, বিশুদ্ধ ভাষা, আরও অন্যান্য গুণ প্রতিপক্ষের প্রতিরোধ মোকাবেলায় কোনও কাজে আসে না। এই গুণাবলী কাজে আসার প্রধান শর্ত হল, কোনও শক্তির আশ্রয় গ্রহণ করা। হারুন আ.-এর বিশুদ্ধভাষার শক্তি কার্যকর ছিল মুসার আশ্রয় ও ছত্রছায়ায় থেকে। বৃহত কোনও শক্তির আশ্রয় না থাকলে, ভাষা দিয়ে বেশি কিছু করা যায় না। হারুন আ.-এর বিশুদ্ধ ভাষা, গোছালো উপস্থাপনের প্রতি, নবী ইসরায়েল ভ্রুক্ষেপই করেনি! বনী ইসরায়েলকে সোজা করেছে, মুসা আ.-এর ‘লাঠির বাড়ি’! কবি মুতানাব্বির একটা লাইন মনে পড়ল! এই কবি ব্যাপারটা বেশ ভালো করেই বুঝেছিলেন। মুতানাব্বি জীবনটা শী‘আ প্রশাসক ‘সাইফুদ্দৌলার’ তল্পিবাহক হয়েই কাটিয়ে দিয়েছিলেন! কবি তার দীর্ঘ অভিজ্ঞতার নির্যাস তুলে ধরছেন,
حتى رجعتُ وأقلامي قوائل لي .. المجد للسيف ليس المجد للقلم
আমি নিজেকে ও কলমকে অনেক যাচাই করে দেখেছি, শেষে এটাই মনে হয়েছে, যাবতীয় সম্মান ‘সাইফ’ (তরবারির)। কলমের কোনও স্বতন্ত্র সম্মান নেই।
এই কবিপ্রবর এই কবিতায়ও তার নুন-খুদদাতার প্রশংসা করতে ছাড়েননি। ‘সাইফ’ বলে তরবারি যেমন বুঝিয়েছেন, পাশাপাশি মনিব’ সাইফুদ্দৌলাকেও বুঝিয়েছেন। এই না হলে আর কবি!
(১৫): দোর্দণ্ডপ্রতাপ ফেরআওনের মুখোমুখি হওয়ার সময়, মরাল সাপোর্টের জন্যে, ভাই হারুনের বিশুদ্ধ ‘ভাষাজ্ঞান’ সহযোগি শক্তি হিশেবে প্রয়োজন ছিল। কিন্তু নিছক ভাষাজ্ঞান দিয়ে দুর্বলের বিরুদ্ধেও জয়লাভ করা যায় না। যে কোনও বিজয়ের জন্যে প্রয়োজন ‘শক্তি’! কঠোর ব্যক্তিত্ব!
(১৬): মুসা আ.-এর ঘটনায়, মূল কার্যনির্বাহিশক্তি ও সহযোগী শক্তির নানাবিধ নমুনা দেখতে পাই। বিশুদ্ধ ভাষাজ্ঞানের মতো আরেকটি শক্তি হল ‘সম্পদ’। রাজনীতিতে সুদৃঢ় অবস্থান কায়েমের জন্যে, অর্থসম্পদ প্রয়োজন। সম্পদ ক্ষমতা ও রাজনীতিকে পাকাপোক্ত করে। ক্ষমতা না থাকলে, নিছক সম্পদের কোনও মূল্য নেই।
(১৭): শুধু বনী ইসরায়েল কেন, ফেরআওনের বংশধারা কিবতিদের মধ্যেও কারুনের মতো সম্পদশালী আর কেউ ছিল না। তার সম্পদের বহর কেমন ছিল? আল্লাহ তা‘আলাই বলে দিচ্ছেন,
وَآتَيْنَاهُ مِنَ الْكُنُوزِ مَا إِنَّ مَفَاتِحَهُ لَتَنُوءُ بِالْعُصْبَةِ أُولِي الْقُوَّةِ
আমি তাকে এমন ধনভাণ্ডার দিয়েছিলাম, যার চাবিগুলি বহন করা একদল শক্তিমান লোকের পক্ষেও কষ্টকর ছিল (কাসাস ৭৬)।
এমন প্রভূত অগাধ ধনভাণ্ডার থাকা সত্বেও, কারুন নিজ সম্প্রদায়ের অবস্থার কোনও উন্নতি ঘটাতে পারেনি। বরং কারুন সুযোগ বুঝে, নিজের সম্পদ বাঁচাতে, স্বপক্ষ ত্যাগ করে, সরকারী দলে যোগ দিয়েছিল। কারুনের সম্পদ ফেরআওনের স্বার্থেই ব্যয়িত হয়েছে। তার কওমের কোনও কাজে আসেনি।
(১৮): সম্পদের বা ভাষাজ্ঞানও ও অন্যান্য সম্পূরক ‘উপাদানের’ নিজস্ব একটা শক্তি আছে। কিন্তু সেটার দৌড় খুব বেশি নয়। আরেকটু কাছের প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করলেও বিষয়টা স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
ক: লক্ষ লক্ষ মানুষ জড়ো হয়েছে। সারাদিন মুখের ভাষা দিয়ে আকাশ-পাতাল তোলপাড় করে দিয়েছে। রাতের আঁধারে ‘রাষ্ট্রশক্তি’ তার স্বমহিমায় আবির্ভূত হয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ‘ভাষাজ্ঞান’ সাফা। কোথাও কেউ নেই। এই বিপর্যয়ের পর, ‘ভাষাজ্ঞানের’ যথার্থ উপলব্ধি হল। এবার ভাষাজ্ঞান ‘রাষ্ট্রশক্তিকে’ তোয়াজ-তাযীম করে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার কৌশল অবলম্বন করল।
খ: বিশাল ব্যাংক। সকাল-সন্ধ্যা গ্রাহকে গিজগিজ করছে। মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার লেনদেন হচ্ছে। কিন্তু কী হল? রাষ্ট্রশক্তি এক ফুৎকারে ‘কারুনের’ ধন ধ্বসিয়ে দিল।
(১৯): রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে, অদৃশ্য শক্তি, জাদুকরি বিদ্যা, পোষা জ্বিনও কোনও কাজে আসে না। দেশের এ-প্রান্ত ও-প্রান্ত চষে বাছা বাছা জাদুকর হাজির করা হল। জাদুকররা নবীর ‘মুজিযা’ দেখে ঈমান আনল। তারপর? রাষ্ট্রশক্তি তাদেরকে টুকরা টুকরা করল, শূলে চড়িয়ে চরম নির্যাতন চালাল। এতদিনের জাদু কোনও কাজে এল না।
ক: রাষ্ট্রক্ষমতার বিরুদ্ধে ‘তসবী’ ও জায়নামায কোনও কাজে আসে না। ব্রাশফায়ার, সাউন্ড গ্রেনেডের তোড়ে, তসবি-জায়নামায মুহূর্তের মধ্যে উবে যায়।
খ: মাদরাসার পাশেই ছিল জলীল খোনার। জ্বিন ছালা দিত। জ্বিন হাজিরা মেলাত। প্রতি মঙ্গলবারে! এক মঙ্গলবারে ‘খোনারালয়’ বন্ধ। কারণ কি? আজ জ্বিন-হাজিরা মেলানো হবে না। আমেরিকা আক্রমণ করেছে ইরাকে। সারা বিশ্বের জ্বিনেরা সব বাগদাদে জড়ো হয়েছে। আবদুল কাদের জিলানী রহ.-এর মাযার হেফাযত করার জন্যে। বাগদাদ রক্ষার জন্যে। কোথায় কি, জ্বিনেরা মার্কিন বোমারু বিমানের বিকট আওয়াজে ‘ওজু’ ভেঙে পালিয়ে এসেছিল। যতসব ভূয়া কথাবাতা
(২০): মোটকথা, ভাষাজ্ঞান বা ‘সুকুমারবৃত্তি’ খুবই প্রয়োজন কিন্তু মূল (রাজনৈতিক/রাষ্ট্রীয়)-ক্ষমতা ছাড়া এসব (لَّا يُسْمِنُ وَلَا يُغْنِي مِن جُوعٍ) কোনও কাজে আসবে না। আয়াতের ভাষায় বলতে গেলে, পুষ্টি যোগাবে না এবং ক্ষুধাও মেটাবে না।
(২১): তবে কাফেরের রাষ্ট্রশক্তি আর মুমিনের রাষ্ট্রশক্তিতে পার্থক্য আছে। মুমিনের রাষ্ট্রশক্তি হবে আল্লাহনির্ভর। শুধু রাষ্ট্রশক্তি কেন, মুমিনের প্রতিটি মুহূর্তই কাটবে আল্লাহর প্রতি সমর্পিত হয়ে। দুই ভাই রাজদরবারে যাওয়ার আগে আল্লাহ তা‘আলার কাছে কাকুতি-মিনতি করে বলেছেন,
رَبَّنَا إِنَّنَا نَخَافُ أَن يَفْرُطَ عَلَيْنَا أَوْ أَن يَطْغَىٰ
হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা আশঙ্কা করি সে কিনা আমাদের উপর অত্যাচার করে অথবা সীমালঙ্ঘন করতে উদ্যত হয় (তোয়াহা ৪৫)।
মুমিন এমনই হবে। সুখে দুঃখে আল্লাহর কাছে ফিরে যাবে। আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করবে। আল্লাহ দুই ভাইয়ের মিনতির প্রেক্ষিতে আশ্বাস দিয়ে বললেন,
وَنَجْعَلُ لَكُمَا سُلْطَانًا فَلَا يَصِلُونَ إِلَيْكُمَا ۚ بِآيَاتِنَا أَنتُمَا وَمَنِ اتَّبَعَكُمَا الْغَالِبُونَ
তোমাদের উভয়কে এমন প্রভাব দান করছি যে, আমার নিদর্শনাবলীর বরকতে তারা তোমাদের পর্যন্ত পৌঁছতেই পারবে না। তোমরা ও তোমাদের অনুসারীরাই জয়ী হয়ে থাকবে (কাসাস ৩৫)।
(২২): শেষকথা হল, হকের পক্ষশক্তির সযযোগী হয়ে, তাকে ‘মেন্টাল সাপোর্ট’ দিয়ে যাওয়া সুন্নতও বটে।
ইলাহি সুন্নত।
নববী সুন্নত।
সাহাবিয়ানা সুন্নত।
ক্ষেত্রবিশেষে ফরযও।
নোটিশ: আপনি কি ব্লগ কিংবা ফেসবুকে ইসলাম এবং সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয়ে লেখালেখি করতে আগ্রহী? তাহলে আপনার লেখা পাঠিয়ে দিন আমাদের কাছে।বিস্তারিত তথ্যের জন্য আমাদের ফেসবুক পেজে মেসেজ দিন। ধন্যবাদ Fb.com/MaqamaeIbrahim
Copyright©2017: IslaameraloII Design By:F.A.CREATIVE FIRM