প্রিন্সিপাল হাবীবুর রহমানঃ একটি নক্ষত্রের মহাপ্রয়াণ
১. আমি সহজে জীবিত ও মৃত কারো ব্যাপারে ইতিবাচক বা নেতিবাচক মন্তব্য করি না। যথেষ্ট জানা-শোনোর পর আত্মার চোখে কারো নেকবখতীর কোনো আলামত দেখলেই তাঁর ব্যাপারে ইতিবাচক কথা বলি (প্রশংসা করি)। একই কথা প্রযোজ্য নেতিবাচক কথা বলার ক্ষেত্রেও। অর্থাৎ, যথেষ্ট জানা-শোনার পর আত্মার চোখে কারো বদবখতী না দেখলে এবং যৌক্তিক কারণ না থাকলে জীবিত বা মৃত কারো নিন্দাজ্ঞাপন করি না।
২. আমি আমার আত্মার চোখের আলোতে যা দেখতে পাচ্ছি, তাতে দেখা যাচ্ছে প্রিন্সিপাল মাওলানা হাবীবুর রহমান আল্লাহর মরহুম (রহমত প্রাপ্ত) ও মগফুর (ক্ষমাপ্রাপ্ত) বান্দাদের অন্তর্ভূক্ত। এটি শুধু তাঁর কর্মের কারণে নয়; তাঁর হৃদয়ের বিশালতা ও মহানুভবতার কারণেও। কারণ, কর্ম ভালো-মন্দ ও মুমিন-মুনাফিক সবাই করে। তাই আল্লাহ হৃদয় বাদ দিয়ে কাউকে শুধুমাত্র তার কর্মের কারণে ছালেহীনদের অন্তর্ভূক্ত করেন না। হৃদয়ের সালামতি (দয়া ও মহানুভতার) কারণে আল্লাহ অনেক ব্যভিচারীকেও ক্ষমা করেন। আবার হৃদয়ের নিষ্ঠুরতা ও সঙ্কীর্ণতার কারণে অনেক আবেদকেও জাহান্নামে নিক্ষেপ করেন। অতএব, গতকাল মারা যাওয়া চট্টগ্রামের বিখ্যাত পপ তারকা আয়ুব বাচ্চুকে কারো জাহান্নামী বলা ঠিক হবে না। আমার জানামতে তিনি গুনাহগার হলেও ইসলামে বিশ্বাসী ও ভালো মনের মানুষ ছিলেন।
৩. প্রিন্সিপাল মাওলানা হাবীবুর রহমানকে আমি জীবনে একবারই দেখেছিলাম এবং তা ২০০২ সালে চট্টগ্রাম মহানগরীর মুসলিম হলে অনুষ্ঠিত খেলাফত মজলিসের একটি উলামা-মাশায়েখ সম্মেলনে। ওই সময় তাঁর সাথে জকিগঞ্জ আসনে নির্বাচিত ইসলামী ঐক্যজোটের সাবেক এমপি (১৯৯১-১৯৯৬) মরহুম মাওলানা উবাইদুল হক সাহেবও ছিলেন। আর উনার বক্তব্যও জীবনে একবার শুনেছিলাম। তাছাড়া ওই সফরে আন্দরকিল্লার যে হোটেলে উনারা অবস্থান করেছিলেন, সেখানেও আমার যাওয়া হয়েছিল হবিগঞ্জের মনসুর খানের সাথে। ওই দিনের বক্তব্যে প্রিন্সিপাল মাওলানা হাবীবুর রহমান উহুদ যুদ্ধের প্রসঙ্গ টেনে আলোচনা করেছিলেন। উনি বলেছিলেন, মুসলমানদের সামান্য ভুলের কারণে উহুদ যুদ্ধে কাফিরদের বিজয় হলে তাদের শীর্ষ নেতা আবু সুফিয়ান চিৎকার দিয়ে বলেছিল, اُعْلُ هُبل ‘হুবল তুমি উপরে যাও।’ হুবল মক্কার কাফিরদের একটি ইলাহে বাতিল তথা মূর্তি ছিল।
৪. প্রিন্সিপাল মাওলানা হাবীবুর রহমান একজন কীর্তিমান পুরুষ। তিনি একদিকে যেমন ইসলামী শিক্ষার প্রসারে বিশাল ভূমিকা রেখেছেন, তেমনি অন্যদিকে সেই শিক্ষার বাস্তবায়নে সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধের জিহাদও করেছেন। নব্বইয়ের দশকে নাস্তিক কবি শামসুর রহমান ও নারীবাদী লেখিকা তসলিমা নাসরিনের বিরুদ্ধে সিলেটে গর্জে উঠা ঈমানদার মুসলমানদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি। সিলেট শহরে দাঁড়িয়ে থাকা কালের সাক্ষী একটি জামেয়ার প্রতিষ্ঠাতা, প্রিন্সিপাল ও শায়খুল হাদীছ হওয়ার পাশাপাশি তিনি একদিকে যেমন সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধের অংশ হিসেবে খেলাফত মজলিসের নেতৃত্ব গ্রহণ করেছিলেন, তেমনি অন্যদিকে তিনি সময় পেলে লেখালেখিও করতেন। আমার জানামতে তিনি বেশ কয়েকটি ইসলামী বইয়ের প্রণেতা।
৫. মহান আল্লাহ মানুষকে বিভিন্ন উসিলায় ক্ষমা করেন। তাঁর ক্ষমা বেশী পান পরোপকারী ও দয়ালু লোকজন। আমার জানামতে প্রিন্সিপাল মাওলানা হাবীবুর রহমানের মাঝে এ গুণটি কমবেশী ছিল। তাঁর নেকবখতীর আরেকটি নিদর্শন হলো তাঁর অসুস্থতা। অসংখ্য ছহীহ হাদীছ দ্বারা শারীরিক অসুস্থতা মুমিনের জন্য আল্লাহর রহমত বলে প্রমাণিত। এ নিয়ে فضل المرض والعيادة فى ضوء القرآن والسنة নামে আমার একটি স্বতন্ত্র আরবী বইও রয়েছে। আজ মধ্যরাতে আল্লাহর ডাকে সাড়া দেবার দুইদিন আগে তিনি ইন্ডিয়া থেকে চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরেছিলেন। তাঁর নেকবখতীর আরেকটি নিদর্শন হলো, তিনি জুমার রাতে ইন্তেকাল করেছেন। জুমার দিন বা রাতে মুমিনদের ইন্তেকাল তাঁদের নেকবখতীর স্পষ্ট ইঙ্গিতবাহী বিষয়। হযরত জাবির رضي الله عنه থেকে বর্ণিত একটি হাদীছ শরীফে এসেছেঃ
من مات يوم الجمعة أو ليلة الجمعة أجير من عذاب القبر وجاء يوم القيامة وعليه طابع الشهداء. أخرجه أبو نعيم فى الحلية (3/155) عن جابررضي الله عنه.
অর্থঃ “যে মুমিন জুমার দিন অথবা জুমার রাতে মারা গেছেন, তাঁকে কবরের আযাব থেকে রক্ষা করা হয় এবং তিনি কেয়ামতের দিন শহীদদের রঙ/সীল নিয়ে উত্থিত হবেন।” [আবু নুয়াইম (৩/১৫৫)]।
প্রসঙ্গত, প্রিন্সিপাল মাওলানা হাবীবুর রহমান ১৯৪৯ সালে সিলেট জেলার গোলাপগঞ্জ উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি সিলেট আলিয়া মাদ্রাসা থেকে কামিল পাশ করেন। ১৯৭৪ সালে তিনি সিলেট শহরের কাজীর বাজারে জামেয়া ইসলামিয়া মাদানিয়া প্রতিষ্ঠা করেন। এর পাশাপাশি তিনি ইসলামী আন্দোলনে জড়িত হন এবং শায়খুল হাদীছ আল্লামা আজীজুল হক রহ. এর নেতৃত্বধীন খেলাফত মজলিসে যোগ দেন। শায়খুল হাদীছের ইন্তেকালের পর তিনি ওই সংগঠনের আমীর নির্বাচিত হন।
শেষ কথা, প্রিন্সিপাল মাওলানা হাবীবুর রহমান তাঁর বহুবিধ কীর্তির কারণে বাংলাদেশের ইসলামী শিক্ষা ও দাওয়াতের ময়দানের একটি উজ্জল নক্ষত্র হিসেবে স্থান করে নিয়েছিলেন। আজ এ নক্ষত্রের মহাপ্রয়াণে এই ময়দানে যে শূণ্যতার সৃষ্টি হয়েছে, তা সহজে পূরণ হবার নয়।
এই সাহসী ও গুণী ব্যক্তির আলোচনা আল্লাহ সমুন্নত রাখুন এবং তাঁর পরিবারবগর্কে তাঁকে হারানোর শোক বহন করার শক্তি দান করুন।
আবুল হুসাইন আলেগাজী
সদর লোহাগাড়া, চট্টগ্রাম।
নোটিশ: আপনি কি ব্লগ কিংবা ফেসবুকে ইসলাম এবং সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয়ে লেখালেখি করতে আগ্রহী? তাহলে আপনার লেখা পাঠিয়ে দিন আমাদের কাছে।বিস্তারিত তথ্যের জন্য আমাদের ফেসবুক পেজে মেসেজ দিন। ধন্যবাদ Fb.com/MaqamaeIbrahim
Copyright©2017: IslaameraloII Design By:F.A.CREATIVE FIRM